অশরীরি – 05 –

Share the story!

ঈদুমিয়ার সেই ঐতিহাসিক আদরের মোরগের পাশাপাশি একটা ছাগল ও পালতো। ঐতিহাসিক বলার কারনতো জানো, না স্মরণ করিয়ে দিব। ঐ যে, সেটাকে প্রথমে গ্রামের চৌকিদার নিয়ে গেল, সেখান থেকে, গ্রামের মেম্বার, তারপর চেয়ারম্যান শেষে দারোগার হাতঘুরে আবারও ইদুমিয়ার কাছে ফিরে আসে। আমার প্রোফাইলে ঘাটলে গল্পটা পেয়ে যাবে, আমি শুধু শেয়ার করেছিলাম।
.
এবার ছাগলের গল্পে আসি। ইদুমিয়া আদর করে একে গদাই বলে ডাকে। দেখতে যেমন নাদুস নুদুস, তেমনি চকচকে হেহারা। এই গদাইকে দুপুর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইদুমিয়ার বাড়ীর পাশেই একটা বাগান বা জঙ্গল আছে। তেমন বড় কোন জঙ্গল না, কয়েকটা বড় বড় গাছ আর কিছু ছোট ও লতাগুলমো। সকালে একটু বেলা হলে ছাগলটাকে ইদুমিয়া ঐ জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে, ঘাস পাতা খাওয়ার পর বিকালের দিকে গদাই একা একাই বাড়িতে ফিরে আসে। আজ সন্ধ্যা হয়ে গেলেও এখনো না ফেরায় ইদুমিয়া আশপাশে খুজতে খুজতে ঐ জঙ্গলের দিকেই অগ্রসর হয়, তার পরেই ঘটে বিপত্তি। তো বন্ধুরা এবার দেখি মরগের মত গদাইও ফিরে আসেকিনা:
” কে রে এই ভর সন্ধ্যাবেলা পায়ে মাথা ঠুকছিস? দু দন্ড শান্তি তে বসতে দিবিনে বাপ?”

গদাইইইই—- গদাইরে— বলে চীৎকার করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরেছিলো ইদুমিয়া। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার মুখেই মাথায় কি একটা লাগতেই চমকে দাঁড়িয়েছিলো। শীতকাল তাই এখন সন্ধ্যা ছটা মানেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। জঙ্গলের মধ্যে ইতিউতি জোনাক জ্বলছে।ঠিক দিক ঠাওর করতে পারছিলো না ইদুমিয়া।কিন্তু ঠকাস করে মাথায় ওটা কি লাগলো।বেশ শক্ত মতো একটা জিনিস। কোন গাছের ঝুরি টুরি নয় তো। কিন্তু এটা তো বেলগাছ।বেলগাছের থেকে কি আর ঝুরি নামে।অন্ধকারের মধ্যেই বোঝার চেষ্টা করছিলো ইদুমিয়া । হঠাৎ একটা ভারি গলা উপর থেকে ভেসে আসতেই উত্তেজনায় প্রায় লুঙ্গি ভিজিয়ে ফেলার জোগাড়।
.
কিন্তু ইদুমিয়া জোয়ান মরদ— সহজে দমবার পাত্র নয়।এ নিশ্চয়ই কোন বাটপাড়ের কাজ। রুখে দাঁড়িয়ে গলা তুললো ইদুমিয়া –” কোন শালার পো রে তুই? সাহস থাকে তো সামনে আয়?

আওয়াজ টা এবার একটু মিহি–” অতো তড়পাস না বাপ আমার! সামনে গেলে তো এখুনি শিবনেত্র হয়ে ভিরমি খাবি। অতোই যদি দেখার সখ, তো একটু চোখ কচলে ওপর দিকে তাকা দিকি। তবে বুকে একটু বল সঞ্চয় করে নে বাছা।আগাবিঘে কিছু হলে কিন্তু আমার দায়িত্ব নেই।”

” কোন শালার বেটা রে “— বলে উপরে চোখ তুলতেই ইদুমিয়া চোখের সামনে ফুলঝুরি জ্বলতে লাগলো। তেমন কিছু দেখতে না পেলেও লম্বা লম্বা দুটো ঠ্যাং যে বেলগাছের মগডাল থেকে ঝুলছে এটা ইদুমিয়া দৃষ্টি এড়ায় নি।

” আল্লাহ্ আল্লাহ্ আল্লাহ্ “— বলতে বলতে ইদুমিয়া প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার জোগাড়।

” আ মোলো যা, এই নাকি তোর 56 ইঞ্চি বুকের পাটা। তা দুটো ঠ্যাং দেখেই দাত ছিরকুট মেরে ভিরমি খেলি? বলি এই ভর সন্ধ্যায় কি জঙ্গলের মধ্যে কাশফুল খুঁজতে সেঁদোচ্ছিলি? বলি, বালিশের কি ঘরে আকাল পড়েছে বাপ? ওরে পাগলা, চোখ খোল। মানুষ টা আমি তেমন খারাপ নই। আর তুই ও আমাকে বেজায় চিনিস। আমি পূব পাড়ার মহাদেব ভটচার্য রে, তোদের চেয়ারম্যান । এই তো দিন বিশেক আগেও তোর সেলুন থেকে দাড়ি কেটে এলাম যে রে।” বলে রাখা ভালো ইদুমিয়ার একটা সেলুন আছে, সে নিজেই সেখানে কাজ করে।

ইদুমিয়ার তখন ধাত ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়–
—-” আজ্ঞে বিলক্ষণ চিনি কত্তা। আপনাকে চেনে না এ তল্লাটে কজন আছে? কিন্তু আপনি তো দিন তিনেক আগে গত হয়েছেন সেটাও তো আমার অজানা নয় “—- ভয়ে আবার কাপতে লাগলো ইদুমিয়া।

” ওরে তুই একটু দম ফেল দেখি, পারলে একটু জল খা। এই যে পাঁচ মিনিট ধরে তুই আমার সাথে কথা বলছিস, তোর গায়ে কি একটা আঁচড় ও পড়েছে? অথচ তোর ওপর আমার বিস্তর রাগ ছিল রে ব্যাটা। পয়সা কম দিতাম বলে তুই ভোঁতা ব্লেড দিয়ে আমার দাড়ি চেছে শুধু ফিটকিরি বুলিয়ে ছেড়ে দিতিস। তাই ইচ্ছে হলেই তোর মুন্ডু টা নিয়ে এখন আমি একটু মেসির মতো ফুটবল খেলতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করবো না। এখন আমি সব বলা কওয়ার উর্দ্ধে উঠে গেছি। তবে আর জঙ্গলে ঢুকিস না বাপ— লাভ নেই। “
.
এতক্ষণে একটু মনে সাহস এলো ইদুমিয়ার–
— কেন কত্তা? আমার গদাই কি ঘরে ফিরে গেছে?

উপরের গলাটা এবার যেন একটু লাজুক—
— ” কিছু মনে করিস না বাপ। সেই তিনদিন আগে শ্মশানে শুয়ে তিল কলা চটকানো আলো চালের পিন্ডি গিলেছিলাম। ও কি আর মুখে রোচে রে? তারপর এই তিনদিন আর তেমন কিছুই জোটেনি।তাই তোর ঐ নধর ছাগল টা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি রে। বেশ রেওয়াজি খাসি ছিল। বেশ আয়েশ করে খেলাম।”

উপর থেকে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলার শব্দ ভেসে এলো। ইদুমিয়া মনে মনে ফুসছিলো।
বেঁচে থাকতে কম জ্বালায় নি বুড়ো। চেয়ারম্যান হয়েও সুদের কারবার করতো। সুদের টাকা দিতে পারে নি বলে কতো লোকের যে জমি, বাড়ির দলিল আটকে রেখেছে আল্লাহ্ ভালো জানেন। যাকে বলে একেবারে হাড়কেপ্পন ছিলো। গাঁয়ের কেউ সহ্য করতে পারতো না। দেরি করে বাজারে যেতো যাতে কম দামে সদাইপাতি পাওয়া যায়।পচা ঘচা জিনিস কিনতো শালা। এখন মরার পরে, ব্যাটার নধর খাসি খাওয়ার লোভ লেগেছে।
.
কিন্তু ভুতের সাথে কি আর তক্কো করা যায়।তবুও মিনমিন করে গলা তুললো ইদুমিয়া–” কিন্তু
ঐ গদাই আমার বড় আদরের ছিল কত্তা। ওকে আপনি রেহাই দিলেই পারতেন।”

উপরের গলাটা এবার একটু গমগমে—” শোন
রে ইদু ,তোকে জঙ্গলে টেনে আনাই আমার উদ্দেশ্য ছিলো। তাই ঐ ছাগলের প্রাণ টা নিতে হলো। না না,আবার কাপতে শুরু করিস না। তোকে দিয়ে আমার কিছু কাজ করিয়ে নিতে হবে।কারণ আর দিন সাত আমি এই গাছে থাকবো, তারপর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবো। তাই এই সাত দিন আমার হাতে সময় আছে।

তোকে যে আমার এট্টু উপকার করতে হবে বাপ।”
হাঁ হয়ে শুনলো ইদুমিয়া। মহাদেব কত্তা যে এমন নির্দেশ তাকে দিতে পারে সেটা সে কল্পনাতেও আনে নি—–” শোন ইদু,অনেক জ্বালিয়েছি তোদের। কিন্তু সেদিন যখন সবাই মিলে আমাকে ঘটা করে জ্বালিয়ে দিলো তখন জ্বলন যে কি জিনিস তা বুঝেছি। তাই মিলিয়ে যাওয়ার আগে কিছু অন্তত ভাল কাজ করে যেতে চাই রে। তোকে একটা চাবির হদিস দিচ্ছি,যেটা আমার পৈতে তে সবসময় বাঁধা থাকতো। আমদের বাড়িতে যাবি, দেখবি তুলসী মঞ্চের বাঁ দিকের কোণে একটা ইঁট সামান্য আলগা। তার নীচেই পাবি চাবিটা। ঐ চাবি নিয়ে সিন্দুক খুললে অনেক দলিল দেখতে পাবি।সেগুলো সব ফেরত দিয়ে দিস বাপ। তোর গিন্নী মা কে আমি স্বপ্নাদেশ দিয়ে দেবো খন। ও কোন বাঁধা দেবে না। আর ও বড্ড ভাল মানুষ ছিল রে।আমাকে যখন সবাই মিলে হরিবোল দিয়ে বের করছিলো— বড্ড কাঁদছিলো রে মানুষ টা। টাকা পয়সা যা রেখে গেলাম তাতে ওর কোন অভাব হয়তো হবে না। কিন্তু তিনকুলে ওর তো আর কেউই নেই। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু পাশে দাঁড়াস।”
পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ ইদুমিয়া আর সেলুনে না গিয়ে সোজা হাজির হলো মহাদেব কত্তার বাড়ি। সেই তুলসীমঞ্চ— বাঁ দিকের কোণের আলগা ইঁট। চাবিটা নেওয়ার সময় ইদুমিয়া ঠিক বুঝতে পারলো তার ঘাড়ে কার যেন একটা নিঃশ্বাস পড়লো।
প্রায় বাহান্ন টা দলিল নাম মিলিয়ে মিলিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার পর ইদুমিয়া দুদিন পর আবার সেই সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে হাজির হলো বেল গাছের নীচে—–” আমার কাজ শেষ কত্তা। তবে লোকজন দু হাত তুলে দোয়া করেছে আপনাকে।”

” ঐ আশীর্বাদ ধুয়ে কি আমি জল খাবো রে বাপ।আমি তো এখন চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছি। আমার যাওয়ার সময় হলো এবার। তুই ভালোয়
ভালোয় ঘরে ফিরে যা। আর তোর গিন্নী মা কে একটু দেখিস। তুই আমার বড্ড উপকার করলি রে।ঘরে গিয়ে দেখিস তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। হঠাৎই হুউউউশ করে একটা ধূলোর ঝড় উঠলো।”

আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে করতে ঘরে ফিরে চললো ইদুমিয়া। মনে তার এখন কোন ভয় নেই।কিন্তু বাড়ির দরজায় ওটা কেএএ? আরেব্বাস— এ তো আমার গদাই। বেশ মনের সুখে পাতা চিবোচ্ছে……..

– সবাই ভালো থাকবেন,

– ধন্যবাদ সবাইকে –